বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ রচনা ২০২৩ Bangabandhu’s 7th March Composition 2023. ভূমিকাঃ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতার এক মহা- নায়ক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে জন্ম না হলে হয়ত আজো আমরা পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ থাকতাম। তিনি না জন্মগ্রহণ করলে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন করতে পারতো না। মূলত বাগালির স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয় বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় ৭১ সালে সংঘটিত হয় মুক্তিযুদ্ধ। এবং এই মুক্তিযুদ্ধে অগ্রনী ভূমিকা রাখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি স্বাধীনতা শব্দের মর্মার্থ বুঝতে পারে। তার এই ১৮ মিনিটের অলিখিত ভাষনের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণ নিপীড়ন ও বাঙালির অধিকার আদায়ে কথা তুলে ধরেন। এবং পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেন।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনেকগুলো দিন আছে, যা আমাদের মনে রাখতে হবে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন। ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে পাকিস্তানি দস্যুদের কামান- বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ দিন বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই আন্দোলনমুখর পরিস্থিতিতে ঘনিয়ে এলো ৭ই মার্চ। সবার দৃষ্টি ৭ই মার্চের দিকে। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে কী বলবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান? ভাবিয়ে তুলল পাকিস্তানের সামরিক চক্রকেও। কারণ তারা বুঝে গেছে, বাংলাদেশের মানুষের ওপর তাদের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশ পরিচালিত হচ্ছে বিরোধী দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথায়। এই অবস্থায় ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু যদি রেসকোর্সের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন!
চিন্তিত পাকিস্তানি সামরিক চক্র কৌশলের আশ্রয় নিল। ৭ই মার্চের এক দিন আগে, অর্থাত্ ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সরকারের তত্কালীন তথ্য কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিকের ‘Witness to Surrender’ গ্রন্থে এসব তথ্য রয়েছে। ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া তার দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে তত্কালীন আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলার চেষ্টা করেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেন এমন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন, যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।
এমন এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্সে তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘৭১-এর ৭ই মার্চ সরাসরি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯৭২-এর ১৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এনডব্লিউ টিভির জন্য দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে ৭ই মার্চের ঐ ঘটনা বর্ণনা করেন। ফ্রস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জানতে চান, “আপনার কি ইচ্ছা ছিল যে, তখন ৭ই মার্চ রেসকোর্সে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেবেন?’ জবাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে এবং সভায় আমি ঘোষণা করি যে এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার।
‘ ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তো কী ঘটত?” জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তর দেন, ‘বিশেষ করে ঐ দিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কেননা, বিশ্বকে তাদের আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আঘাত হানা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। ইতিহাস প্রমাণ করে, ৭ই মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শতভাগ সঠিক কাজটিই করেছেন।
উল্লেখ্য, ঐ ভাষণের ১৮ দিন পর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে গণহত্যার মাধ্যমে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালি জাতি ৯ মাসের যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল।
৭ই মার্চের ভাষনের গুরুত্ব. বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি মূলত স্বাধীনতার ডাক ছিল। তিনি তার এই ছোট্ট একটি ভাষনের মাধ্যমেই সমগ্র বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলেন। তার এই ভাষনের মাধ্যমে বাঙ্গালির অধিকার ও পাকিস্তানিসে শাসন ও শোষণের চিত্র তুলে ধরে। তিনি ৭ই মার্চের বিকাল ২.৪৫ মিনিট হতে ৩.০০ মিনিট পর্যন্ত এই ১৮ মিনিটে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেন। এবং বর্ণনা করেন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা। এর পাশাপাশি সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানান। এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য সর্বস্তরের বাঙ্গালীকে আহ্বান জানান। এবং এই আন্দোলন দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান সহ বাঙ্গালী জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেন।
বিশ্ব ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আন্তর্জাতিক তালিকাই মূলত মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের ঘটনার সংরক্ষণ ও সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে ইউনেসকো। এই তালিকায় ঠাঁই পেতে হলে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক প্রভাব থাকতে হয়।
প্যারিসে ইউনেসকোর প্রধান কার্যালয়ে ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর চার দিনের এক সভায় বসেছিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি (আইএসি)। সেখানে ইউনেসকোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল নিবন্ধনের জন্য ৭৮টি দলিলকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। আইএসির এই কমিটিতে ছিলেন ১৫ জন বিশেষজ্ঞ। এর চেয়ারম্যান ছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল আর্কাইভের মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আলরাইজি। তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে নতুন করে প্রস্তাব করা ঐতিহাসিক দলিল পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করেন। দুই বছরের প্রক্রিয়া শেষে ২০১৬-১৭ সালের জন্য দলিলগুলোকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
মনোনয়নগুলো সম্পর্কে সুপারিশ করে ইউনেসকোর মহাপরিচালক ইরিনা বকোভা তখন বলেছিলেন, “আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, এ কর্মসূচি পরিচালিত হওয়া উচিত দালিলিক ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য। যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সংলাপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শান্তির চেতনা তাদের মনে লালন করতে পারে।’
১৯৯২ সালে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রাম চালু করে ইউনেসকো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দালিলিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও ব্যবহারে সচেতনতার তাগিদে এটি চালু হয়। যুদ্ধ ও সামাজিক অস্থিরতা, সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে দালিলিক ঐতিহ্য নিয়ে সমস্যা বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন সংগ্রহশালা বিনষ্ট হয়েছে। লুটপাট, অবৈধ বিক্রি, ধ্বংস, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও তহবিলের উদ্যোগে নষ্ট হয়েছে দলিল। অনেক দলিল নষ্টের ঝুঁকিতে।
উপসংহার
বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তার এই ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন বাঙ্গালির অন্তরে স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ে। বাঙ্গালী স্বাধীনতার জন্য প্রানের মায়া ত্যাগ করে হাসিমুখে মৃত্যু বরন করতেও পিছপা হয়নি তার এই ভাষনের কারনে। তার এই ভাষন আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে যেমন কাজ করেছিল ঠিক তেমনি আজও এই ঐতিহাসিক ভাষনটি বিশ্বের প্রতিটি কোনায় কোনায় বাঙ্গালী জাতিকে পরিচয় করিয়ে দেয়। এনে দেয় সম্মান!