জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিতে পড়াশোনা করে বিসিএস ক্যাডার হলেন শেখ তৌহিদুল কবীর
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিতে পড়াশোনা করে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ঘটনা বিরল। বিগত বিসিএসগুলোতে হাতে গোনা যে কয়জন ডিগ্রি পাস প্রার্থী বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে শেখ তৌহিদুল কবীর একজন। তিনি ৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
শেখ তৌহিদুল কবীর বলেন, আমার বাবা শেখ রেজাউল করিম ও মা নাজমিনা বেগম। আমরা দুই ভাই। আমি ছোট। ২০০৮ সালে এইচএসসি সম্পন্ন করার পর প্রথমবার ভর্তিযুদ্ধে ব্যর্থ হই।এরপর সিদ্ধান্ত নিই ডিগ্রিতে (পাস কোর্স) ভর্তি হওয়ার। ২০১১ সালে এই কোর্সে ভর্তি হই রাজশাহী কলেজে।
ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় আমি আমার চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। এ ক্ষেত্রে আমার বড় ভাই আমার মেন্টরের ভূমিকা পালন করেন। মূলত বড় ভাইয়ের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আমার বিসিএসের পথচলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলে আমি বিশ্বাস করি। ২০১৪ সালে ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও সেশনজটের কারণে ডিগ্রি শেষ হয় ২০১৬ সালে।
ডিগ্রিতে রাজশাহী কলেজে বিএসএস থেকে মেধাক্রমে তৃতীয় হয়েছিলাম। ২০১৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স ফাইনাল সম্পন্ন করার পর আমি চাকরির পরীক্ষা দেওয়া শুরু করি।
মাস্টার্স শেষ করার পর আমার হাতে তিন বছরের মতো সময় অবশিষ্ট ছিল। ২০১৮ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে আবেদন করি। ২০২০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়ে যোগ দিই। ওই সময় ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়, আবেদন করি। ৪১তম বিসিএস ছিল জীবনের প্রথম বিসিএস। এর মধ্যে ২০২২ সালে আমি হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে অডিটর পদে নিয়োগ পাই। বর্তমানে আমি এখানেই কর্মরত। ডিগ্রিতে পড়ার সময় আমার প্রস্তুতি ছিল প্রিলিমিনারিভিত্তিক। প্রিলির প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমার দুর্বল দিকগুলোর প্রতি বিশেষ যত্নবান হই। এ জন্য আমি গণিতের প্রতি বাড়তি নজর দিই। এ ছাড়া অন্য বিষয়গুলোকেও প্রাধান্য দিই।
২০২১ সালে ৪১তম বিসিএস প্রিলি অনুষ্ঠিত হয়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই, যা আমার আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এরপর লিখিত প্রস্তুতি শুরু করি। লিখিত প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমি বাজারের প্রচলিত গাইড বইয়ের পাশাপাশি নিয়মিত অনুবাদ চর্চা করতাম।বিভিন্ন ধরনের ডাটা আমি আলাদা খাতায় লিখে রাখতাম। আমি মনে করি, বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় টাইম ম্যানেজমেন্ট একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে বাংলা, বাংলাদেশ বিষয়াবলি, আন্তর্জাতিক, বিজ্ঞান—এগুলোতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুরো প্রশ্ন কাভার করতে পারলে তা আপনার নম্বরপ্রাপ্তিতে বাড়তি মাত্রা যোগ করতে পারে। ইংরেজির জন্য ফ্রিহ্যান্ড লেখার চর্চা করতাম। গাইড বইয়ের মডেল প্রশ্ন থেকে passage চর্চা করতাম। লিখিত পরীক্ষায় আমি কোনো বিষয়েই মুখস্থনির্ভর পড়িনি। সব বিষয়েই ধারণা নিয়ে সে বিষয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। মূলত লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি হতে হবে পরিকল্পনামাফিক।
সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুতি নিতে পারলে বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। ২০২২ সালের নভেম্বরে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। রেজাল্ট শিটে আমার রোল দেখে আমার আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে যায়। এরপর শুরু হয় আমার ভাইভা প্রস্তুতি। ভাইভার জন্য শুরুতে আমি ‘ভাইভা বোর্ডের মুখোমুখি’ বইটি সংগ্রহ করি। এই বইটি আমাকে ভাইভা প্রস্তুতি কিভাবে নিতে হবে এটি বুঝতে বেশ সহায়ক হয়েছে। আমি বিভিন্ন সাম্প্রতিক বিষয়ে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করি। প্রতি মাসের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স থেকে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর তথ্য একটি খাতায় নোট করি। এ ছাড়া নিজের পঠিত বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু নিয়ে পড়াশোনা করি। যেহেতু আমার প্রথম পছন্দ ছিল প্রশাসন, তাই প্রশাসন সম্পর্কেও ধারণা নিই। বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি বই পড়ি। আমি মনে করি, চাকরিপ্রত্যাশীদের বঙ্গবন্ধুর তিনটি বই অবশ্যই পড়া উচিত। আমার ভাইভা পুরোটাই বাংলায় হয়। অনেকের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে যে ভাইভা বোর্ডে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব কম দেওয়া হয়। এটি একটি ভুল ধারণা। আমার কাছে একবারের জন্যও এমনটি মনে হয়নি। বোর্ডের আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করে।
ভাইভা শেষ করে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা শুরু হয়। অবশেষে আগস্টের ৩ তারিখ আমার অপেক্ষার পালা শেষ হয়। প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত দেখে প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
আমি মনে করি, বিসিএস যতটা না মেধার পরীক্ষা, তার চেয়ে অনেক বেশি ধৈর্য আর একাগ্রতার পরীক্ষা। যিনি একাগ্রচিত্তে লেগে থাকতে পারবেন, তিনি অবশ্যই সফল হবেন বলে আমি মনে করি।