এই প্রথম চাঁদের অদেখা অংশে অবতরণ করলেন চীনা নভোযান
চাঁদের যে অংশটি পৃথিবী থেকে কখনোই দেখা যায় না, সেই দূরবর্তী দিকে এই প্রথম একটি রোবট চালিত মহাকাশযান নামিয়েছে চীন।
চীনের মহাকাশযান চাঙ-আ ৪ চন্দ্রপৃষ্ঠে সফলভাবে অবতরণ করেছে বলে দাবি করছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। এটিকে চীনের মহাকাশ কর্মসূচীর জন্য এক বিরাট সাফল্য বলে মনে করা হচ্ছে।
চাঙ-আ ৪ চাঁদের দূরবর্তী দিকের যেখানে ভূমি স্পর্শ করে, সেটি `সাউথ পোল এইটকেন বেসিন` নামে পরিচিত। চাঁদ গঠিত হওয়ার একেবারের শুরুর দিকে বিরাট কোন সংঘর্ষের ফলে সেখানে এই বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
চীনের মহাকাশ কর্মসূচীর বয়স বেশি নয়। ২০০৩ সালে চীন প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশযান পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পর তারা হচ্ছে তৃতীয় কোন দেশ যারা মহাকাশ কর্মসূচীতে এরকম সাফল্য দেখালো।
আগামী কয়েক বছরে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাকাশ টেলিস্কোপ ও বিশ্বের সবচেয়ে ভারী রকেট উৎক্ষেপণ এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মতো নিজেদের মহাকাশ স্টেশন বসানোর পরিকল্পনা করছে।
চীনের মহাকাশ কর্মসূচীর পাঁচটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হচ্ছে:
১. চাঁদে অভিযান
চীনের চাঙ-আ মহাকাশযানটির নাম রাখা হয়েছে এক চীনা দেবীর নামে। চীনা উপকথা অনুযায়ী, এই দেবী চাঁদে উড়ে যেতে পারেন। ২০০৩ সালে চীন তাদের কর্মসূচী শুরু করে। তাদের পরিকল্পনা হচ্ছে ২০৩৬ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানো।
চাঁদের উল্টোপৃষ্ঠে কোন মহাকাশযানকে অবতরণ করানো বেশ কঠিন বলে মনে করা হয়। কারণ মহাকাশযানের সঙ্গে পৃথিবীর সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে চাঁদ নিজেই একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এই সমস্যার সমাধানের জন্য চীন পৃথিবী আর চাঁদের মাঝখানে একটি `রিলে স্যাটেলাইট` বসিয়েছে। পৃথিবী থেকে এই স্যাটেলাইটের দূরত্ব প্রায় চার লাখ কিলোমিটার। এই স্যাটেলাইট থেকেই চীনের লুনার ল্যান্ডার এবং রোভারের সিগন্যাল পাঠানো হচ্ছে।
চাঙ-আ ৪ অনেক যন্ত্রপাতি বহন করে নিয়ে গেছে চাঁদে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্য। চাঁদের উল্টোপৃষ্ঠের অনেক কিছুই যেহেতু এখনো পর্যন্ত অজানা, তাই সেখানে তারা যন্ত্রপাতি পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করবে।
একটি `মিনি বায়োস্ফেয়ার` বা জীবমন্ডল তৈরি করে সেখানে আলু ফলানো যায় কীনা, কিংবা রেশমগুটি ফুটানো যায় কীনা, তা নিয়েও পরীক্ষা চালাবে চীন।
পৃথিবী থেকে কখনোই যে চাঁদের একটি পৃষ্ঠ দেখা যায় না, সেটিকে `টাইডাল লকিং` বলে বর্ণন করা হয়। এর মানে হচ্ছে, চাঁদ যে গতিতে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, ঠিক সেই একই গতিতে এটি নিজের অক্ষের ওপর ঘুরে। ফলে চাঁদের একটি অংশ পৃথিবী থেকে অদেখা থেকে যায়। যাকে চাঁদের `ডার্ক সাইড` বলেও বর্ণনা করা হয়।
২. সবচেয়ে বেশি রকেট উৎক্ষেপণ
২০১৮ সালে মহাকাশে সবচেয়ে বেশি রকেট পাঠিয়েছে চীন। মোট ৩৯টি রকেট উৎক্ষেপণ করে চীন, এর মধ্যে বিফল হয়েছে মাত্র একটি। মহাকাশে এক বছরে সর্বোচ্চ রকেট পাঠানোর এর আগের রেকর্ডটি ছিল ২০১৬ সালে, সেবছর পাঠানো হয়েছিল ২২টি রকেট।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র পাঠিয়েছে ৩৪টি রকেট আর তৃতীয় স্থানে ছিল রাশিয়া। তারা উৎক্ষেপণ করে ২০টি রকেট।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের মহাকাশ কর্মসূচীর পেছনে খরচ করে ৩৬ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে সেবছর চীন খরচ করেছিল ৫ বিলিয়ন ডলারেরও কম।
কিন্তু পৃথিবীর কক্ষপথে প্রচুর স্যাটেলাইট বসাতে চীন এখন `সুপার-হেভি লিফট` এবং পুর্নব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরি করছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে রকেট পাঠানোর খরচ কমাতে এখন ব্যক্তিখাতের কোম্পানিকে এই কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। ইলন মাস্কের `স্পেস এক্স` এই কাজে যুক্ত। চীনেও একটি বেসরকারি কোম্পানি একই কাজ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্ত সফল হয়নি।
৩. মহাকাশ স্টেশন
চীন তাদের মহাকাশ স্টেশন কর্মসূচী শুরু করেছে ২০১১ সালে। সেবছর তারা `টিয়াংগং-ওয়ান` নামে একটি স্টেশন পাঠায়। টিয়াংগং মানে হচ্ছে `স্বর্গের প্রাসাদ`।
তবে চীনের এই মহাকাশ স্টেশনটি বেশ ছোট। সেখানে নভোচারীরা গিয়ে থাকতে পারেন, তবে খুবই স্বল্প সময়ের জন্য, মাত্র কয়েকদিন। চীনের প্রথম মহিলা নভোচারী লিউ ইয়াং ২০১২ সালে সেখানে গিয়েছিলেন।
২০১৬ সালে `টিয়াংগং-ওয়ান` এর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর ২০১৮ সালে এটি ভেঙ্গে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে ভূমন্ডলে ঢুকে পড়ে।
চীনের দ্বিতীয় মহাকাশ স্টেশন `টিয়াংগং-টু` এখনো সচল। ২০২২ সাল নাগাদ একটি পূর্ণাঙ্গ মহাকাশস্টেশন চালুর পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। এই মহাকাশ স্টেশনটি হবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের সমতুল্য এবং সেখানে সবসময় কোন না কোন নভোচারী অবস্থান করবেন।
৪. এন্টি-স্যাটেলাইট ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা
চীন মহাশূণ্যে ঘুরতে থাকা কোন স্যাটেলাইট ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে ২০০৭ সালে। তাদের আগে এই সক্ষমতা ছিল কেবল যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার।
এই কাজে চীন ব্যবহার করেছিল ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। তখন অনেক দেশ চীনের এই কাজের সমালোচনা করে। তবে চীন তখন বলেছিল, তারা মহাকাশের সামরিকীকরণ চায় না। সেখানে কোন অস্ত্র প্রতিযোগিতা দেখতে চায় না।
তবে ২০১৬ সালে চীন `আওলং-ওয়ান` নামে একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে। এটি মূলত মহাকাশ থেকে বিকল হয়ে যাওয়া বড় বড় স্যাটেলাইট বা এরকম বর্জ্য সংগ্রহ করে। মহাকাশকে বর্জ্যমুক্ত করতে চীন এরকম আরও স্যাটেলাইট পাঠানোর পরিকল্পনা করছে।
পৃথিবীর কক্ষপথে এখন নাকি ২০ হাজারের বেশি এরকম বর্জ্য রয়েছে, যেগুলো আকারে একটি `সফট বলের` চেয়ে বড়। এগুলি মূলত বিভিন্ন বিকল মহাকাশযান বা স্যাটেলাইটের অংশ। চীনারা স্যাটেলাইট দিয়ে এসব সংগ্রহ করে আবার ভূমন্ডলে নিয়ে এসে ধ্বংস করে দেয়ার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার চেষ্টা করছে।
তবে চীনের এই একই প্রযুক্তি যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের স্যাটেলাইট বিকল করতে ব্যবহৃত হতে পারে বলে আশংকা আছে।
গত বছর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক বাহিনীর একটি নতুন শাখা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। এটির নাম দেয়া হয়েছে `স্পেস ফোর্স`। চীনও আবার যুক্তরাষ্ট্রের মতি-গতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের সন্দেহ যুক্তরাষ্ট্রে মহাকাশভিত্তিক সমরাস্ত্র উদ্ভাবনের দিকে যাচ্ছে। সেজন্যেই হয়তো তারা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বিরোধী চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে।
৫. কোয়ান্টাম যোগাযোগ
সাইবার স্পেসে তথ্যের গোপনীয়তা এবং সুরক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে চীন ২০১৬ সালে এক বিরাট সাফল্য অর্জন করে।
তারা এমন এক স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে, যেটি গোপন যোগাযোগের চ্যানেল স্থাপন করতে পারে। প্রাচীন এক চীনা বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক মিসিয়াসের নামে এই স্যাটেলাইটের নাম রাখা হয়েছে। কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের সূত্র ব্যবহার করে চীনারা এই স্যাটেলাইটের কম্যুনিকেশন চ্যানেল চালায়, যেটিতে কারও পক্ষে আড়ি পাতা কঠিন।
কোয়ান্টাম কম্যুনিকেশনকে এতটা দুর্ভেদ্য মনে করার কারণ হচ্ছে, কেউ এটিতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে সাথে সাথেই তা ধরা যায়।